বর্তমান বিশ্বে চিকিৎসাক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নতির পরও মূর্তিমান এক বিভীষিকার নাম হয়ে আছে ম্যালেরিয়া। এ রোগ ঠেকানো এবং এর চিকিৎসা সম্ভব হলেও প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ২০ কোটি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা'র হিসেব মতে, গত বছর এ রোগে চার লক্ষ আটত্রিশ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে, যার বেশিরভাগই ছিলো সাব-সাহারান অঞ্চলে।
ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটিতে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি শিক্ষার্থী ২৬ বছর বয়স্ক জন লিওয়ানদোওস্কি বানিয়েছেন র্যাম (র্যাপিড অ্যাসেসমেন্ট অফ ম্যালেরিয়া ডিভাইসটি। এর সাহায্যে একফোঁটা রক্ত থেকে পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে রক্তে ম্যালেরিয়া জীবাণুর উপস্থিতি চিহ্নিত করা যাবে।
তিনি বলেন, "প্রাথমিক পর্যায়েই যাতে এ রোগের চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হয় তাই লক্ষণ শুরু হওয়ার পাঁচ থেকে সাতদিন আগেই রোগের জীবাণু চিহ্নিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।"
বিশেষত আফ্রিকা ও এশিয়ার গ্রাম্য অঞ্চলগুলোতে, যেখানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ তুলনামূলক বেশি অথচ মাইক্রোস্কোপ বা অন্যান্য ব্যয়বহুল ডায়াগনোস্টিক টেস্টের সাহায্যে রোগ নির্ণয়ের সুযোগ-সুবিধা নেই, সেখানে এ ডিভাইসের সাহায্যে কম খরচে অল্প সময়ের মধ্যেই রোগ নির্ণয় করা যাবে বলে আশা করছেন ডিভাইসটির নির্মাতা বোস্টনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডিজিজ ডায়াগনোস্টিক গ্রুপ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী লিওয়ানদোওস্কি।
তিনি জানান, রক্তে ম্যালেরিয়া জীবাণুর উপস্থিতির ফলে আয়রন ক্রিস্টাল বা হেমোজয়েন তৈরি হয়। এ ক্রিস্টালগুলোর চৌম্বক ধর্ম ব্যবহার করে খুব কম সময়ের মধ্যেই রক্তে এ রোগের জীবাণুর উপস্থিতি চিহ্নিত করার ধারণাটি নিয়ে কাজ করেন বলে জানান তিনি।
ব্যাটারিচালিত এই ডিভাইসটি বানাতে সাকুল্যে খরচ হবে একশ' থেকে একশ' বিশ ডলার। এতে ৪ইঞ্চিX৪ইঞ্চি আকারের একটি প্লাস্টিক বক্সের ভেতরে রয়েছে একটি ছোট সার্কিট বোর্ড, কিছু চুম্বক এবং একটি লেজার। এর বাইরের অংশে রয়েছে একটি এলইডি স্ক্রিন, একটি এসডিসডি কার্ড স্লট এবং ফেলে দেওয়া যাবে এমন একটি প্লাস্টিকের তৈরি টিউব। এ টিউবে এক ফোঁটা রক্ত প্রবেশ করালেই চুম্বকের আকর্ষণে হেমোজয়েনগুলো নির্দিষ্ট সন্নিবেশে সন্নিবিষ্ট হয়ে পড়বে, যা লেজারের সাহায্যে ধরা পড়বে।
লিওয়ানদোওস্কি বলেন, "এতে জটিল কোনো কারিগরি নেই।"
২০১৩ সাল থেকেই ভারতে এ ডিভাইসটির কার্যকারিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়াও এ বছরই নাইজেরিয়ায় ৫০০০ রোগী নিয়ে গবেষণা চালানো হবে বলে জানান লিওয়ানদোওস্কি।
তিনি বলেন, "ভারতে আড়াইশ' রোগী নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় ৯৩ থেকে ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত সঠিক ফলাফল পাওয়া গেছে।"
জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও হেমোজয়েন বিশেষজ্ঞ ডেভিড সালিভান এ প্রযুক্তিটি "অসাধারণ" বলে মন্তব্য করেন। তিনি জানান, কিছু কিছু ক্ষেত্রে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই ম্যালেরিয়া রোগীর মৃত্যু ঘটতে পারে, আর দ্রুতগতির কারণে কিছুটা হলেও সুফল বয়ে আনতে পারে এই ডিভাইসটি।
লিওয়ানদোওস্কি জানান, তারা নতুন কোনো পদ্ধতি আবিষ্কার করতে যাচ্ছেন না, বরং "এ প্রযুক্তির সাহায্যে একই প্রক্রিয়ার গতি বৃদ্ধি এবং খরচ কমিয়ে" আনছেন।
তিনি আরও জানান, ডেঙ্গুজ্বর এবং জিকা ভাইরাসের মতো অন্যান্য মশকীবাহী রোগে এ প্রযুক্তি কীভাবে ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে কাজ করছে তা প্রতিষ্ঠানটি।
এ ডিভাইসটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এবং ইইউ হেলথ অ্যান্ড সেইফটি সার্টিফিকেশন বিভাগের অনুমতির জন্য জমা দেওয়া হয়েছে। এক বছরের মধ্যেই এই ডিভাইসটি বাজারে ব্যাপকভাবে পাওয়া যাবে এবং ক্রমান্বয়ে তা উচ্চ ম্যালেরিয়া ঝুঁকি সম্বলিত এলাকায় প্রতিটি পরিবারের হাতের নাগালে পৌঁছে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন লিওয়ানদোওস্কি।
তিনি বলেন, "সমাজসেবাই আমাদের মিশন। আমরা চাই এটি যাদের সবচেয়ে বেশি দরকার তারাই যেনো সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে।" সূত্রঃ বিডিনিউজ২৪.কম
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন